বাংলা ভাষাবিদ্যা চর্চার আড়াই শতক


(বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের "ভাষা আকাদেমি' প্রকাশিত "আকাদেমি পত্রিকা -২০১৬' তথা 'ভাষা ও সংস্কৃতি বরাক উপত্যকা' সংখ্যাতে প্রকাশিত হলো। ১৯-০৬-২০১৬)

দিও বা বাংলা-অসমিয়া ভাষার বয়স হাজার বছর অতিক্রম করেছে প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে বাংলা ভাষাতে ব্যাকরণ-অভিধান রচনার কোনও নজির নেই। ভাষা নিয়ে যত টীকা-ভাষ্য কিম্বা বিতর্ক সবই হচ্ছে সংস্কৃতে। বাংলাতে লিখলেপ্রসাদ গুণথাকে, রচনা রসালও হয়তবু আমরা জানি রাজসভার কবি বলে অভিজাতদের ভয়ে ভারত চন্দ্রকেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে কেন তিনি ব্যবহার করবেন, ‘ভাষা যাবনী মিশাল।কারণ একটি শাস্ত্র নির্দেশ ছিল, “ অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ।/ ভাষায় মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্রজেৎ।একই কথা ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞদের সম্পর্কেও। পৃথিবীর বহু দেশে ইসলামের শুরু থেকেই কোরানের অনুবাদ হয়ে গেলেও ভারতীয় কোনো ভাষাতে প্রথম কোরান অনুবাদ হয়েছিল মাত্র আঠারো শতকে। করেছিলেন শাহ ওয়ালি-উল্লাহের পুত্র আব্দুল কাদির উর্দুতে। বাংলাতে কোরান-হাদিসের ভাবানুবাদ জাতীয় কাজ করতে গিয়েও কবিদের কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে এরকম, “মুসলমানী শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ/ বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।আহমদ শরীফের দাবি এই পঙক্তিগুলো কবি মুত্তালিব লিখেছেন ১৬৩৯এ। এবংবাঙ্গালা' শব্দেরও এই প্রথম ব্যবহৃত হয়। এই দাবি গোলাম মুরশিদ মেনে নেন নি, তাঁর বক্তব্য মনোএল দ্য আসসুম্পসাউ প্রথম ভাষা নাম বেঙ্গালাব্যবহার করছেন। হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকাশের ছ বছর পরে জোনাথান ডানকান কোম্পানির একখানা আইনের বই অনুবাদ করেন, সেখানে তিনি ভাষার নাম বাঙ্গলাবলে অনুবাদ করেছেন, ইংরেজিতে কথাটা তখনো Bengal language বাংলাকথাটা আসলে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যবহার করেন। তারপরেও শব্দটি প্রচলিত হতে বহু সময় নেয়। তার নজির, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি বইয়ের নামবাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা সুকুমার সেনের সুপরিচিত সাহিত্য ইতিহাস বইটির নাম বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস মূল কথা প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে ভাষা কিম্বা জনগোষ্ঠী বোঝাতে নাম হিসেবে বাংলাকথাটার কোনও প্রচলনই নেই। রাষ্ট্র বিভাগ বোঝাতে আছে। চৌদ্দ-পনের শতকে বাংলার শাসক সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথম শাহে বাঙ্গালিয়ানবলে নিজের উপাধি নিয়েছিলেন। কিন্তু কথাটি বহু প্রচলিত হয় নি। মোঘল সুবাহর নাম ছিল বাঙ্গলাহ তাতে প্রথম দেশ নাম জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ভুসুকুতে যে বঙ্গালীশব্দের উল্লেখ আছে, কিম্বা মুকুন্দরামে ---‘কান্দেরে বাঙ্গাল ভাই বাফোই বাফোই’---সে আসলে পূর্ববাংলার লোকজনকে বোঝাতেই । গোলাম মুরশিদ এটা লিখেছেন। ভারতচন্দ্রই প্রথম পুরো বাংলার অধিবাসী বলতেবাঙালিকথাটার ব্যবহার করেছেন-- “ বাঙালিরা কত ভালো পশ্চিমার ঘরে।তিনিও ভাষা বলতে ঐ রৌরব নরকের ভয় দেখানো শাস্ত্রবাক্যের মতোভাষাই ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ তাঁর আগে দেশি ভাষাব্যবহার করছেন। ষোড়শ শতকের কবি আবদুল হাকিমবঙ্গ বাণীকথাটা ব্যবহার করছেন বটে, “ যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী’—ভাষা বোঝাতে তিনিও জনপ্রিয় দেশী ভাষাকথাটারই ব্যবহার করছেন---‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।দাঁড়ালো এই যে ভাষার কোনও নাম নেই, তার আকার প্রকার নিয়েও কোনও নিশ্চয়তা নেই, কোনও তর্কও নেই। ব্যাকরণ-অভিধান রচিত হবে, আমরা আশা করতে পারি না।
    
       পর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউরভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস১৭৪৩এ পর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়। বাংলা ভাষাতে এটিই ভাষাচিন্তারও প্রথম বই। এটি মূলত একটি অভিধান, সঙ্গে সামান্য ব্যাকরণ ছিল। অভিধান লিখতে গিয়ে ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্যের আভ্যন্তরীণ সূত্র নির্ণয় করতে হয়েছিল তাঁকে। তাতেই বাংলা ভাষাচিন্তার সূচনা হলো। আজকের পরিচিত মান বাংলাভাষাতে লেখা নয় বইদুটো বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত, তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই মনোএল লিখেছিলেন এ দুটো বই। কিন্তু লিখবার জন্যে যে হরফের ব্যবহার করেছিলেন , সেটি বাংলা ছিল না। ছিল রোমান। সম্ভবত এই কারণেই বইটি খুব প্রচার পায় নি। তাঁর কাছে রোমানে লেখাটা ছিল এক বাধ্যবাধকতা কারণ ছাপা বইয়ের জন্যে উপযোগী যে প্রায়োগিক হরফের দরকার ছিল সেটি কী হবে, কেমন হবে-- তা স্থির করতে আমাদের অপেক্ষা করত হয়েছিল আরও চার দশক। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ইংরেজিতে লেখা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘A Grammar of the Bengal Language’ বইতেই বাংলা হরফ প্রথম ব্যবহৃত হয়। চার্লস উইলকিন্সনস এবং তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার গুটেনবার্গের উদ্ভাবিত মুদ্রণ প্রযুক্তিটিকে বাংলার উপযোগী করে তুলেন এবং প্রথমবারের মত প্রয়োগ-সম্ভব করেন। ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতি একই হরফের জন্য একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা হরফে একটা স্থায়ী, বৈষম্যহীন রূপ এসেছিল। বছর দশের পরে ১৭৮৮তে লন্ডনে প্রকাশিত আরেক অজ্ঞাত সংকলকের দি ইণ্ডিয়ান ভোকাবুলারিতে হাজার দেড়েকের মতো বাংলা শব্দ ছিল। ১৭৯৩তেআপজনবলে কেউ প্রকাশ করেন, ‘ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকাবিলরি হ্যালহেডের পরে উল্লেখযোগ্য বই আসলে হেনরি পিটস্ ফরস্টারের এ ভোকাবুলারিম ইন টু পার্টস ইংলিশ অ্যান্ড বোঙ্গালি অ্যান্ড ভাইস ভার্সানামের অভিধানের প্রথম খণ্ড। সতেরো শতকে বাংলা ভাষা চিন্তার এই পাঁচ বই। সব কটাই বিদেশীদের লেখা । এই ফরস্টারের বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড দিয়ে উনিশ শতকের শুরু। সময় ১৮০২হ্যালহেড এবং ফরস্টারের বই দুটি বহু-পঠিত এবং অন্যদের প্রেরণার স্রোত হিসেবেও কাজ করে। ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর মিশন ইত্যাদি এবং তার বাইরেও বিচিত্র সব বাংলা ও অন্যান্য ভাষাতে বই পত্রিকা ছাপা হতে শুরু করেফলে ভাষা বিতর্কেও জোয়ার আসে। প্রচুর অভিধান , ব্যাকরণ রচিত হতে থাকে। পুরো উনিশ শতক এই অভিধান-ব্যাকরণ রচনারই শতক মূলত। অধিকাংশই দ্বিভাষিক। হুমায়ুন আজাদ লিখছেন, “ উনিশ শতকের শেষ দশকে তুলনামূলক-কালানুক্রমিক পদ্ধতির কিছুটা প্রয়োগ দেখা যায় সবার আগে রবীন্দ্রনাথের বাঙলা ভাষা বিষয়ক রচনায়। উনিশ শতকের প্রথম ন দশকে ভরে বাঙলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা প্রধানত রচনা করেন প্রথাগত-আনুশাসনিক অভিধান ও ব্যাকরণ; এবং গৌণত লিপ্ত হন বিশুদ্ধ বাঙলার শুদ্ধরূপ বিষয়ক কলহে, সাধুচলতির বিতর্কে; কিন্তু মোটামুটি ভাবে এগোতে থাকেন তাঁরা প্রথাসম্মত পথ ধরেই যতদিন না প্রকাশিত হয় বঙ্গীয়- সাহিত্য- পরিষদের অদ্বিতীয় গবেষণা পত্রিকা...সুনীতি কুমারও রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রথম বিখ্যাত গ্রন্থের (ODBL) মুখবন্ধেই লিখেছেন, “ ...But the first Bengali with a scientific insight in to attack the problems of the language was the poet Rabindranath Tagore…” সুকুমার সেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন, “ ভাষাবিজ্ঞানের সূত্র ধরিয়াই রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাঙ্গালাভাষার উচ্চারণরীতির এবং ব্যাকরণের কোনও জটিল সমস্যার বিশ্লেষণ ও সমাধান করিয়াছিলেন। ...এই প্রবন্ধগুলির কথা মনে রাখিলে রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম বলিতেই হয়।
            আঠারো শতকের শেষের দিকে ভারতের রাজধানী শহর কলকাতাতে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার সভাতে উইলিয়াম জোনসের বক্তৃতাতে যদিও কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্বের সূচনা হয়েছিল এই ধারা এরপরে দীর্ঘদিন কেবল ইউরোপেই সমৃদ্ধ হয়। এর কিছু উড়ো উড়ো খবর বরং বাঙালিদের মধ্যে এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করছিল যে সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী ঐ উনিশ শতকের শেষের দিকে জন বীমস, জ্যুল ব্লক, গ্রীয়ার্সন আর হ্যর্নলের কাজগুলোর মধ্য দিয়েই শুধু বাঙালি প্রথম এর সঙ্গে পরিচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এদের আদি পুরুষ। সুনীতি কুমার এরপর পূর্ণ প্রথম পুরুষ। এঁর আগেকার সংস্কৃতের মানসপুত্রদের কাছে আদর্শ ছিল সংস্কৃত,ইংরেজি, এমন কি লাতিন অভিধান ব্যাকরণও। হুমায়ুন এক দীর্ঘ নামের তালিকা দিয়েছেনতাতে বোঝা যাচ্ছে প্রথম বাঙালি অভিধান প্রণেতা পীতাম্বর মুখোপাধ্যায় এবং মোহন প্রসাদ ঠাকুর। ১৮০৯ এবং ১৮১০ পরপর দুই বছরে দুজনের অভিধান বেরোয়। উইলিয়াম কেরির অভিধান ফরস্টারের পরে বড় উদ্যোগ। দীর্ঘ নামটি ছিল এ ডিকশনারি অফ দি বেংগলি ল্যাংগুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়ার্ডস আর ট্রেডস টু দেয়ার অরিজিন, অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮১৫তে, দ্বিতীয় খণ্ড বেরোয় ১৮২৫এ। এই বইতে তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলা অচিরেই একটি প্রধান ভাষা হয়ে উঠবে। এই আশার দরকার কী ছিল আমরা বুঝিনি। জন মার্সম্যানের বই বেরোয় ১৮২৭এ। ১৮৩৩এ রাজা রামমোহন রায়ের বিখ্যাত গৌড়ীয় ব্যাকরণেসংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার তফাতের দিকে অঙুলি নির্দেশ করা হলেও, বিতর্ক খুব জমে নি। একই বছরে বেরোয় জি সি হটনেরএ ডিকশনারি, বেংগলি অ্যান্ড স্যান্সক্রিট/ অ্যাকসপ্লেইণ্ড ইন ইংলিশ সেকালে এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল তিন হাজার। বিদ্যাসাগরের লিপি নিয়ে কিছু কাজ ছিল, ‘বর্ণপরিচয়' নামে বিখ্যাত বইটিরও তিনি প্রণেতাদুই একটি পুরোনো বর্ণ বাদ দিয়ে, নতুন বর্ণের আমদানিও করেন তিনি। পুরোনো লিপির রূপান্তরও ঘটান। তবু ভাষা-ব্যাকরণ-অভিধান নিয়ে ১৩০০ সালে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যে প্রয়াস শুরু হয় তাঁদের জার্মানইয়ুং গ্রাম্মাতিকার’-এর প্রতিতুলনাতে “ ‘নব-ব্যাকরণবিদঅভিধা দিলে অত্যুক্তি হয় নাবলে লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। বাংলা ভাষার ধ্বনি, রূপ, বাংলা ব্যাকরণ কাঠামো, পরিভাষা, আঞ্চলিক উপভাষা ইত্যাদি নিয়ে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকাতে প্রচুর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। নিয়মিত বৈঠকেও সেগুলো নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে থাকে। সেই বিতর্কের ঢেউ কখনো সমকালীন অন্য কাগজেও গিয়ে পৌঁছোয়। তবে সেখানেও প্রাচীন পন্থী ছিলেন যারা সংস্কৃতের আধিপত্যে আস্থা রাখতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, শ্রীনাথ সেন এমন অনেকে। পরবর্তী কাল এঁদের মনে রাখবার কারণ খোঁজে পায় নি। বাংলার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাতে যারা সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঠাকুর ভাতৃদ্বয়দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রনাথের উপসর্গ নিয়ে আলোচনা এবং বিরোধীদের জবাবে রবীন্দ্রনাথের রচনাতে বাংলাভাষাতে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। মূলত দুটি বই ১৯১৫তে প্রকাশিতশব্দতত্ত্বেএবং প্রায় চারদশক পর ১৯৩৮এ বাংলা ভাষা পরিচয়েরবীন্দ্রনাথের ভাষা চিন্তার প্রবন্ধগুলো ধরে রাখা আছে। তেইশটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ বাংলাভাষা পরিচয়একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। ১৯৩৮এ এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেপে বের করে। ততোদিনে ভাষাচার্য রূপে স্বীকৃত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন এটি।  বইটি নিজেই একটা অসামান্য ব্যাকরণ বলে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু সেটি, প্রণালীবদ্ধ ছিলনা। বিজন বিহারী ভট্টাচার্য তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এই বইটিকে ভাষাবিজ্ঞানের ভূমিকা হিসেবে নিয়ে যেন তিনি সেই পথে কাজ আরম্ভ করেন। তিনি সেটি করেন নি। এই বইতে দেখা মিলবে ভারতের প্রথম সমাজ ভাষাবিজ্ঞানীরও বটে। এছাড়াও তখন ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিধুশেখর ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র রায় প্রমুখ অনেকে। এঁদের প্রায় সবার হাতেই বাংলা বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল সোস্যুরকে না জেনে তার আগে বা সমকালেই । ষাটের দশকের আগে আর এদিকে কেউ তাকান নি তেমন। অভিধান সংকলনেও তাই এই সময়ে কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি জুড়েছিল। এই অভিধানগুলোকে আমরা এখনো মনে এবং ব্যবহারে রেখেছি। যেমন ১৩২৩এ প্রকাশিত জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’, ১৩৪০-৫৩তে প্রকাশিত বিশালাকার বঙ্গীয় শব্দকোষ’; রাজশেখর বসুর চলন্তিকাএবং ১৯৫৫তে প্রকাশিত শৈলেন্দ্র বিশ্বাসের সংসদ বাঙ্গালা অভিধান। ফরস্টারের অভিধানেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত প্রায় করে তুলে শুদ্ধ করে তুলবার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কেরিতে এসে সেই প্রয়াস আরও জোরালো হয়। তার উপরে সাহেব বা বাঙালি আভিধানিক, সবার সামনে ছিল জনসনের আনুশাসনিক ইংরাজি অভিধান আদর্শ স্বরূপ। তাঁরা ঐ পথেই হাঁটেন।
      

   ১৮৭২এ জন বীমস অন্য পথে হাঁটার প্রস্তাব করেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর সদর্থক ভূমিকা ছিল । তিনি নিজেও একখানা বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন ১৮৭২এ। হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরিরা যে যথেচ্ছে সংস্কৃতাধিপত্য করেছিলেন, বাংলা ভাষাকে তাঁর বিপরীতে মোড় ফিরিয়ে দিতে বীমস উদ্যোগী হন। বঙ্কিমের বাঙ্গালা ভাষাপ্রবন্ধের প্রেরণাও আসলে তিনিই ছিলেন। ভাষাকে অদরকারি সংস্কৃতের চাপমুক্ত করবার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় এবং অশালীন শব্দমালার থেকে মুক্ত করবার প্রস্তাবও তাঁরই ছিল। বঙ্কিম যে আলালের ভাষাকে গ্রহণ করলেও হুতুমী ভাষার আদর করেন নি তা এরই জন্যে। রবীন্দ্রনাথ যে তৎসম ভার-বহুল সাধুবাংলাকে ছেড়ে সুললিত চলিত বাংলাকে প্রতিষ্ঠা দিতে উঠে পড়ে লাগলেন তাঁর প্রেরণাও জন বীমস বললে অত্যুক্তি হয় না। যদিও তাতে প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে সারা বাংলাতে ভাষারযাবনী মিশালযে সাধারণ রূপটি গড়ে উঠেছিল, যার উপরে ভিত্তি করে সাধুবাংলা গড়ে উঠেছিলসেই ভাষাটি অকারণে মার খেল। সব কিছুর পরেও হুমায়ুন আজাদেরও যেন কেরি কিম্বা বীমসএই সব পাশ্চাত্য ভাষা পরিকল্পকদের প্রতি আনুগত্যটি  প্রশ্নাতীত। তিনি লিখেছেন, “ সংস্কৃতের সাহায্য ছাড়া দু-শো বছরের কম সময়ে বহু আঞ্চলিক বাঙলা ভাষা আজকের বাঙলা ভাষা হয়ে উঠতে পারত না।বুঝিবা এতোটাই দুর্বল ছিল বাংলা। এমনও নয়, যে নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-ঢাকা-সিলেট-আরাকানে যে এক সাধারণ সাহিত্যের ভাষা সেকালেই গড়ে উঠেছিল এই নিয়ে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না। সাধুরীতির সম্পর্কে মোটাদাগে বলা চলে যে নাম-পদগুলো সে নিয়েছিল সারা-বাংলাতে প্রচলিত প্রায় সমস্ত ভাষাবৈচিত্র্য থেকেই। যাবনী মিশেলও তাতেই হতে পেরেছিল। কিন্তু সমাজে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য থাকার ফলে এবং সংস্কৃতের চর্চা প্রবল থাকার ফলে সংস্কৃত তৎসম শব্দগুলো আপনাতেই কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই ভাষাতে এসেছিল। কিন্তু ক্রিয়াপদের পরসর্গগুলো স্পষ্টতই পূর্ববাংলা বা বাংলার বৃহত্তর অংশের থেকে আমদানি। এ সম্পর্কে চলিতরীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাপকেরও সুগভীর ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না। প্রমথ চৌধুরী ভেবেছিলেন, নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষাবৈচিত্র্যই সাধুর ভিত্তি।চলিতরীতির ভিত্তি অঞ্চলও প্রায় একই। এবং এই অভিমত এমন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, যে মনে হয় যে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাতে উত্তর বা পূব বাংলার কোনোদিনই কোনও সবল ভূমিকা ছিল না। তার উপরে যদি স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষাবিজ্ঞানী লেখেন, “ ঠিক কোন উপভাষা (টি-গুলো) ভিত্তি করে সৃষ্ট হয়েছিল সাধুভাষা, তার সুনিশ্চিত ভাষাতাত্ত্বিক বিবরণ আজও অনুদ্ঘাটিত।”—তবে তো সোনায় সোহাগা। তিনি নিজে যখন সাধুর রূপতাত্ত্বিক আলোচনা করেন, ক্রিয়াপদ গুলোর পূর্ববঙ্গীয় স্বরবাহুল্য বা দীর্ঘায়ন প্রবণতা আশ্চর্যরকম তাঁর নজর এড়িয়ে যায়। অথচ জানেন, ‘ক্রিয়া সহায়কের ভিন্নতাই এ-রীতি দুটির মৌল ভিন্নতা।যার নাম ছিল দেশীভাষা’,সেই সাধারণ রূপটি কে উনিশ শতকের শুরুতে এমন রিসাইকেলবা সংস্কৃতায়ন করতে শুরু করলেন কেরিরা যে পরের শতকে গামলার জলের সঙ্গে বাচ্চাটিকেই ছুঁড়ে ফেলবার মতো কাজ হয়ে গেলো। এই নজির দেখায় ভাষা কিম্বা জাতির ইতিহাস মোটেও ধারাবাহিক ঘটনা-প্রবাহ নয়। এখানে ওখানে কাটা ছেঁড়া আছে।  আমরা যদিও বলি বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরের , ঘটনা হলো সবুজপত্রেরকথা মনে রাখলে, আজকের মান বাংলার বয়স শত বর্ষ পার করছে মাত্র।দেশী ভাষার সঙ্গে সাধু রীতির যদি বা কিছু সম্পর্ক ছিল, ‘ চলিত মান বাংলামোটেও তার ধারাবাহিক উত্তরাধিকার বহন করে না। অথচ, সবগুলোই মূলত লেখার ভাষা। হ্যালহেড , কেরিরা বাংলাকে আরবি ফার্সি মুক্ত করবার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। বীমস পরবর্তী কালে গ্রীয়ার্সন থেকে রবীন্দ্রনাথ আবার বিপরীত অভিমত দাঁড় করাতে শুরু করেন। বীমসই প্রথম অক্সফোর্ড অভিধানকে আদর্শ করে নিয়ে অভিধান রচনাতে হাত দিতে পরিষদকে প্রস্তাব দেন। বিশ শতকের যে কটি অভিধানের নাম আমরা উল্লেখ করলাম, সেগুলোতেই এই পথে হাঁটা শুরু হয়েছিল। জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাঁর অভিধানে পূর্বতন সমস্ত অভিধানকে বিভক্তি-বিহীন সংস্কৃত শব্দবাহুল্যেভরা বলে অভিযুক্ত করেছেন। অভিধান চিন্তার সঙ্গে ওতপ্রোতও জড়িত বানান সংস্কারঅবশ্য তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রণ যন্ত্রের বিকাশ এবং প্রচলনেরও একটা অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা আছে। যার জন্যে অভিধানে এতো এতো লোক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। উনিশ শতকে তৎসম শব্দবাহুল্যের সঙ্গে সঙ্গে তদ্ভব বাংলা বানানকেও সংস্কৃতের মতো ব্যুৎপত্তি নির্ভর করে ফেলবার চেষ্টা করা দেখে, রবীন্দ্রনাথও বিরক্ত হয়ে বাংলা ভাষা পরিচয়েলিখেছিলেন, “ বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে বাংলায় তত তৎসম শব্দ নেই বললেই চলে।
        

চর্যাগান ইত্যাদির আবিষ্কারের পেছনেও এই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এবং তাদের পত্রিকার প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেগুলোর আবিষ্কার ভাষাবিজ্ঞানের পুরো দৃষ্টিকেই কালানুক্রমিক তথা ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের দিকে দৃষ্টি নিয়ে যায়। এবং এই পরিস্থিতিতেই তিন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞানী বাংলা ভাষা বিদ্যার কালানুক্রমিক চর্চার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সুকুমার সেন। তাঁদের কাজে ভাষার এবং সাহিত্যের ইতিহাসের বহু অজানা দিক উন্মোচিত হয়েছে বটে, তার থেকে আমরা এখনো লাভান্বিত হচ্ছি, কিন্তু একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে ইতিহাসের সূত্র আবিষ্কারই ভাষা বিজ্ঞানের কাজ। তাঁরা যখন ব্যাকরণ লিখেছেন, তখন সেগুলোতে “...রে যেতে পারেন নি প্রথাগত পথ থেকে: তাঁরা অনুসরণ করেছেন প্রথাগত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণপ্রণেতাদের; এবং কালানুক্রমিক উপাত্তের সাহায্য নিয়েছেন সমকালীন বাঙলা ভাষা ব্যাখ্যা বর্ণনায়।” (হুমায়ুন আজাদ) হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাঙ্গালা ব্যাকরণে’ (১৩০৮) উল্লেখ করেছিলেন যে তাঁদের আগে পর্যন্ত বাংলা ভাষাতে প্রায় আড়াইশত ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল। কিন্তু যোগেশ চন্দ্র রায় রামমোহনের বইটি সহ চারখানাকে মাত্র পাতে নেবার যোগ্য মনে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো স্পষ্টই লিখে ফেললেন, ‘প্রকৃত বাঙলা ব্যাকরণ একখানাও লেখা হয় নাই।রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ১৩০৮এ লেখা বাঙ্গালা ব্যাকরণপ্রবন্ধে বর্ণনামূলক ব্যাকরণে দিশা নির্দেশ ছিল শুধু তাই নয়, তিনি বহু পরে প্রবর্তিত চমস্কির রূপান্তরমূলক সৃজনী ভাষাবিজ্ঞানের ভাবনারও কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন বলে হুমায়ুন আজাদ দাবি করেছেন। কিন্তু তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই এই বিচ্ছিন্ন কিছু রচনাই লিখেছেন। উদ্যোগ নেননি, গভীরে গিয়ে আদর্শ কোনও ব্যাকরণ রচনার। ফলে বিশশতকে যখন ভাষার ইতিহাস সন্ধানের জোয়ার উঠে, ব্যাকরণে বইতে থাকে সেই পুরোনো স্রোত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহের বাঙ্গালা ব্যাকরণআমরা দেখেছি, আজাদের মতোই আমাদেরও মনে হয় নি এই বই কোনও ভাষা বিজ্ঞানীর রচনা বলে। এই ঘরানা থেকে প্রথম বেরিয়ে আসেন পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকাএবং বাংলা একাডেমী পত্রিকাতে ধ্বনি নিয়ে বিভিন্ন রচনাতে। দুই পত্রিকারই প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৫৭তে। তিনি ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার জন্য যান। সেখানে অধ্যাপক জে আর ফার্থের নির্দেশনায় A Study of Nasals and Nasalization in Bengali শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। তিনি ধ্বনি বিজ্ঞানে পূব-পাকিস্তানের ছাত্রদের এতোটাই উদ্বুদ্ধ করেন যে ষাটের দশকে প্রচুর ছাত্র বিদেশে গিয়ে ধ্বনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে ফেরেন। তার মধ্যে অধ্যাপক মুনির চৌধুরী অন্যতম। ভাষাবিজ্ঞানে পূব-পাকিস্তান তথা এখনকার বাংলাদেশের এই ভূমিকার কথা রামেশ্বর শও স্বীকার করেছেন। তিনি লিখেছেন শহীদুল্লাহের পরে বাংলাদেশের ভাষা বিদ্যাচর্চার সবটাই এই বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে। (ভাষাবিজ্ঞানে) ক্ষেত্রে বাংলাদেশে (পূর্ব বাংলা) গবেষণাও বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। সে তুলনায় পশ্চিম বাংলায় এ ক্ষেত্রে গবেষণার ফলশ্রুতি (output) অপেক্ষাকৃত কম।অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর নাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও মৌলিক অবদানের জন্যে মনে রাখতে হবে। টাইপ রাইটারের জন্যে বাংলা কী-বোর্ড প্রচলন তাঁরই অবদান। পরে যেটি মুনির অপটিমা নামে বিখ্যাত হয়। এবং সেই লে-আউট উন্নীত হতে হতে এখন কম্প্যুটারেও ইউনিকোড লে-আউটে বিকশিত হয়েছে। মুক্তি যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
          উনিশ-বিশ শতকে বাংলা ভাষা বিদ্যা চর্চার জোয়ার এলেও একটি বড় দুর্বলতা হলো এগুলোর অধিকাংশই বিদেশী এবং দেশী গবেষকদের দ্বারা ইংরেজিতেই লেখা হয়েছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ও ডি বি এল ইংরেজিতেই লেখা। এবং এর আজ অব্দি কোনও বাংলা অনুবাদ হয় নি। সর্বোপরি এটি তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ। বাংলা বা ভারতীয় ভাষাগুলো নিয়ে বিদেশে ইংরেজিতে এমন বহু গবেষণা কর্ম বাঙালিরা গিয়ে করলেও, পরের কালে বাংলা ভাষাতে কোনও কাজে সেরকম আন্তরিকতা দেখান নি। ফলে বাংলা ভাষাতে ভাষা বিজ্ঞান চর্চার ধারাটি যথেষ্ট সবল হবার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও হয়ে উঠতে পারে নি। এই নিয়ে হুমায়ুন আজাদ আক্ষেপ করেছেন। তাঁর সেই আক্ষেপ করবার অধিকার ছিল। কেননা তিনি সেই মনোয়েলের থেকে শুরু করে আড়াইশ বছরে প্রকাশিত রচনার বাছাই সংকলন সম্পাদনা করেছেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের ভাষাতে সংস্কৃতের স্বৈরাচার চলছিল বলে যিনি শুধু অভিযোগই করেন নি, ‘সংস্কৃত বাংলার জননী ভাষাএই তত্ত্বের ইতিহাস আশ্রয় করে প্রথম ভ্রান্তি নির্দেশ করেন সেই সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৬৬তে প্রকাশিত সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণথেকে নজির টেনে হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যের কিছুটা তুলে ধরলে এই দুর্বলতার অনেকটাই ধরা পড়বে, “ সুনীতি কুমারউত্তরপদের স্ত্রী বাচক প্রত্যয় লোপসূত্রের সাহায্যে গঠন করেছেন দৃঢ়-প্রতিজ্ঞসলজ্জশব্দ দুটি। তাঁর বিশ্লেষণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যাহারসহ লজ্জা যাহার বাক্যাংশ (প্রথাগত পরিভাষায় সমস্যমান পদ’) দুটি প্রতিজ্ঞালজ্জাশব্দের ’ ( যাহার’) বর্জন করে পরিণত হয়েছে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞসলজ্জশব্দে। কিন্তু এমন রূপান্তরের আর্থ ও রৌপ্য সূত্র আরও অনেক জটিল-সূক্ষ্ম, তা শুধু উল্লিখিত সূত্রের সাহায্যেই উদ্ঘাটিত হতে পারে না। তাই প্রথাগত ব্যাকরণে সমাসের যে-সব বিধি প্রদত্ত হয়, তা নানা রকম ইঙ্গিত দেয় মাত্র, ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে-আর্থ ও রৌপ্য উভয় দিক থেকেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে না। এমন বিশৃঙ্খলা দেখা যায় প্রত্যয় ও উপসর্গ-যোগে শব্দ গঠনের সূত্রেও। প্রাত্যয়িক রূপতত্ত্বের কাজ হচ্ছে বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার সময় শব্দরাশির যে-সমস্ত রৌপ্য পরিবর্তন হয়, তার শৃঙ্খলা বর্ণনা করা। প্রথাগত বাঙলা ব্যাকরণে এ-সব পরিবর্তিত রূপের ব্যাখ্যা বিস্তৃত ভাবে, যদিও অনেকাংশে ভ্রান্তভাবে, করা হয়ে থাকে।আমরা সেই ভ্রান্তির একটির দিকে নজর টেনে সহজেই লিখতে পারি, ‘সহ লজ্জা যাহারসহজ এবং বোধ্য বাংলা বাক্যই নয়।
           সুনীতি কুমারের পরে অধিকাংশই মন দিয়েছেন, কে কার থেকে সঠিকতর সমগ্র ভাষার ইতিবৃত্তলিখতে পারেন। ফলে আলাদা করে নিবিড় উপভাষা চর্চাও খুব বেশি এগোয় নি বাংলা ভাষাতে। ১৯৪০ অব্দিতো তন্ন তন্ন করিয়া কোনও বাঙ্গালা উপভাষার ভৌগোলিক জরিপ ( Dialect Grography) ... প্রস্তুত হয় নাই।আগের বছরে প্রকাশিত বিখ্যাত ইতিবৃত্তেলিখেছিলেন সুকুমার সেন। বাংলার সুপরিচিত পাঁচটি উপভাষা রাঢ়ি, বরেন্দ্রি, ঝাড়খণ্ডি, বঙ্গালি এবং কামরূপির আলোচনা করলেও বটিতে তিনি লিখেছেন এগুলো আসলে উপভাষাগুচ্ছ বলতে গেলে উপভাষা চর্চার শুরু বাংলা ভাষা বিদ্যার আদি-গ্রন্থ মনোএলের অভিধানেই। কিন্তু এরতো কোনও ধারাবাহিকতা রইল না। শত বর্ষেরও বহু পরে ১৮৬৭তে সরকারি উদ্যোগে সিলেট কাছাড় সহ পূব বাংলার কিছু জেলার আলাদা আলাদা ইতিহাস এবং পরিসংখ্যানপ্রকাশিত হয় তাতে বেশ কিছু জেলাগুলোতে প্রচলিত ভাষাবৈচিত্র্যের শব্দ সংকলিত হয়। এর পরে বড় কাজটি অবশ্যই গ্রিয়ার্সনের ভাষা সমীক্ষা। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় গ্রিয়ার্সনের উপভাষা বিভাজনে কিছু রদবদল ঘটান। প্রতিষ্ঠিত প্রায় সমস্ত বইতে এগুলোই সামান্য আলোচিত হয়ে এসেছে। বীমস-এর পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যরা সারা বাংলার শব্দ সংগ্রহে নামেন। রবীন্দ্রনাথ তাতে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, আমরা আগেই লিখেছি। অনেকে সেগুলো নিয়ে বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধাবলীও লিখেছিলেন। কিন্তু গভীরে গিয়ে প্রণালীবদ্ধ কাজ কিছু হয় নি। যদিও এই সময় এক সাহেব পার্জিটার ভোকাব্যুলারি অফ পিক্যুলার ভারনাকুলার বেংগলি ওয়ার্ডসনামে এক ঔপভাষিক শব্দকোষ রচনা করেন। কিন্তু বাংলাতে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৫তে । পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানসংকলন করেন। একই রকম অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এমন এক কাজ খণ্ডে খণ্ডে সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। নাম আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান।
             সুনীতি কুমার ভাষা বিজ্ঞানের গবেষণা করতে গিয়েছিলেন বিলেতে , শহীদুল্লাহ গেছিলেন প্যারিসে। ততদিনে ভাষাবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র সরে যাচ্ছিল আমেরিকাতে। কিছুদিন পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সোভিয়েত প্রভাবিত পূর্ব ইউরোপে। ১৯২৪শেআমেরিকান লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটিপ্রতিষ্ঠিত হলে সোসাইটির কাগজ ল্যাঙ্গুয়েজদুনিয়া জুড়েই ভাষা বিজ্ঞানীদের প্রধান মুখপত্রে পরিণত হয়। অনেকটা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাষাবিজ্ঞান চর্চার শুরু তখন থেকেই। এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন এডোয়ার্ড স্যাপীর এবং লিওটার্ড ব্লুমফিল্ড। সুইস ভাষাবিজ্ঞানী সোস্যুরের ভাষাচিন্তাকে আশ্রয় করে কাঠামোবাদের মূল প্রতিষ্ঠাপকই এই ব্লুমফিল্ড। অন্যদিকে তখন চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগ-গোষ্ঠীও সোস্যুর প্রবর্তিত বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন।এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিকোলাই ত্রুবেৎস্কয়। এছাড়াও রুশফর্মালিস্টএবং মার্ক্সবাদীদের বিভিন্ন শাখাও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছিলেন। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়াতে যে যান্ত্রিক মার্ক্সবাদীরা ভাষার শ্রেণি চরিত্র আবিষ্কারে অত্যুৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরব হতে হয়েছিল যোশেফ স্তালিনকেও। ১৯৫০এ মার্ক্সবাদ এবং ভাষাবিজ্ঞানের সমস্যাশিরোনামে ১৯৫০এর জুন, জুলাই, আগস্টে তাঁর একগুচ্ছ সাক্ষাৎকার এবং লেখালেখি প্রকাশিত হয় প্রাভদাতে। যেগুলো পরে বই আকারে বেরোয়। ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে সম্ভবত প্রথম পূর্ণাঙ্গ এক মার্ক্সীয় গ্রন্থ এটি। এই পরিবেশ বাংলা ভাষা বিজ্ঞান চর্চাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাতে ইন্ধন যোগায় বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি তথা ভাষা আন্দোলন। কালানুক্রমিক ভাষাবিদ্যা থেকে এককালিক ভাষাবিজ্ঞানে আগেভাগে বাংলাদেশে মোড় ফেরার রহস্যই এই।
          ১৯৪৪-৪৬ এ আমেরিকার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস ফার্গুসন এবং তাঁর সহযোগীদের নেতৃত্বে বাংলা পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ফার্গুসন এর পরে বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতিতে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলা ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করেন। সোভিয়েতের ভাষা চর্চা সম্পর্কেও তিনি বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। মস্কোরইন্সটিটিউট অফ দি পিপলস অফ এশিয়াবাংলা ভাষা চর্চার এক প্রধান কেন্দ্র ছিল। সম্ভবত অসমিয়ারও। লেনিন গ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলা ভাষা চর্চার আরেক কেন্দ্র ছিল। বহু রুশি বই বাংলাতে বা ইংরেজিতে অনুবাদ হলেও ভাষাবিজ্ঞানের বইগুলো সম্ভবত কমই হয়েছে। সেগুলো আমাদের কাছে কম পরিচিত থেকেছে। কিন্তু মার্কিনিদের সেই সমস্যা ছিল না। আব্দুল হাই নিজে লন্ডনে গেলেও তাঁর ছাত্র এবং সমকালে বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাবিজ্ঞানী মুনির চৌধুরী ফার্গুসনের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। দুজনে মিলে দি ফোনিমস অফ বেংগলিলিখেছিলেন ১৯৬০এই। একই বছরে আব্দুল হাইর বই এ ফোনেটিক এন্ড ফোনোলোজিক্যাল স্টাডি অব ন্যাসালস্‌ এন্ড ন্যাসালাইজেশন ইন বেঙ্গলীও প্রকাশ পায়। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ এবং সমকালীন নব্য-ব্যাকরণবিদদের বহু পরে কোনও বাঙালির দ্বারা ভাষাবিজ্ঞানের পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু সেগুলোও লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। ১৯৬৪তে প্রকাশিত মুহম্মদ আব্দুল হাই-ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্বইআসলে বাংলা ভাষাতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রথম বই। এর পরে ধ্বনি তত্ত্ব, রূপ তত্ত্ব, অর্থ-বাক্য তত্ত্ব, এমন কি মার্কিন ইহুদী ভাষা বিজ্ঞানী চমস্কির রূপান্তরমূলক-সৃজনী ভাষাবিজ্ঞানেও বাঙালির আগ্রহে জোয়ার আসে। ভারতে তথা পশ্চিম বাংলাতে তাঁর ছোঁয়া লাগতে আরও এক দশক অপেক্ষা করতে হয়। উপভাষা এবং প্রতিবেশি ভাষাগুলো নিয়ে আগ্রহের জোয়ারও এই সময়েরই ঘটনা । অন্যথা এর আগেপ্রত্যয়-উপসর্গ-কারক-বিভক্তি -কালইত্যাদি নিয়ে প্রথাগত পথেই অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ ছিল। অথবা সংস্কৃত- পালি- প্রাকৃত এই সব ইতিমধ্যে মর্যাদা সম্পন্ন ভাষা নিয়েই আগ্রহ ছিল ব্যাপক।
       
   
  আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কথা বলে এসেছি। বলিনি একই সময়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েতুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের সূচনা হলে তার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন গুজরাটি ভাষাবিজ্ঞানী জে এস তারাপুরওয়ালা সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এই বিভাগেরই ছাত্র ছিলেন। লন্ডন গিয়ে তাঁর গবেষণা কর্ম করবার আগে পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এবং তাঁর মহাগ্রন্থ দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজএই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯২৬শে ছেপে বেরোয়। এই গ্রন্থে বাংলাকে কেন্দ্র করে বলতে গেলে প্রধান ভারতীয় ভাষাগুলো নিয়েই , বিশেষ করে পূর্বভারতীয় আর্য-অনার্য ভাষাগুলো নিয়েও ব্যাপক তুলনামূলক অধ্যয়ন সেরে রেখেছিলেন। এতো বিশালাকার কাজ বাংলা ভাষাতে আর কেউ করেন নি। সংস্কৃত যে বাংলার জননী ভাষা নয়, সে ভাষা প্রাকৃত --এই কথা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন জন বীমস। এর পরে এই তত্ত্বকে তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন, প্রাকৃত তথা মধ্যভারতীয় আর্য নিয়ে প্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ই। সুতরাং তাঁকে শুধু বাংলার উপভাষা বা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়েই পরে কথা বলতে হয় নি, আর্য ভাষার সব কটা স্তরের ঔপভাষিক চরিত্র নিয়ে বিস্তৃত অধ্যয়ন করতে হয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে কোনও ভারতীয় ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস ভারতীয় হিসেবে তিনিই প্রথম লিখছেন। প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর কেন্তুম ও সতম গুচ্ছ বিভাজন যে ভৌগোলিক এবং জাতিগতও এটা তাঁরই আবিষ্কার। আর্যরা অবিমিশ্র জাতি নয় এই তত্ত্বকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালির আর্য অহমিকাকে জোর ধাক্কা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষার সঙ্গে মোঙ্গল নৃগোষ্ঠীয় ভাষাগুলোর সম্পর্কের দিকে তিনিই প্রথম নজর কেড়েছিলেন। বহুদিন তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না, এ দিকটাতে। এখনো এই নিয়ে ত্রিপুরা বা উত্তর বঙ্গ বাদ দিলে কাজ বিশেষ এগোয় নি।কিন্তু এর পরেই তাঁর মূল আগ্রহ গিয়ে পড়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাস অধ্যয়নে। কিরাতজনকৃতি বা দ্য পিপল, লাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার অফ ওড়িশাসেরকমই বই। হিন্দি , দ্রাবিড় ভাষা নিয়েও আলাদা রচনা আছে তাঁর। কিন্তু সেসবই ইংরেজিতে। তাঁর ইংরেজি রচনা বিশের বেশি। বাংলাতে অতি সামান্যই। তাতে একটা লাভ এই হয়েছে যে তাঁর রচনাবলী গোটা ভারতেই ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞান চর্চাতে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। বহু ভারতীয় আপন আপন ভাষাতে অনুরূপ কাজ করতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে সুনীতি কুমারের ছাত্র বাণীকান্ত কাকতিও আছেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বইটি ছাড়াও , তারাপুরওয়ালার ১৯৩১শে প্রকাশিত বই এলিমেন্টস অফ দ্য সাইন্স অফ ল্যাঙ্গুয়েজতখন বাঙালি তথা ভারতীয় ভাষা জিজ্ঞাসুদের পথ দেখাচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে সারা ভারতেই ভাষা বিজ্ঞানের কেন্দ্র। মুহম্মদ শহীদুল্লাহও এই বিভাগের প্রথম ছাত্র এবং পরে অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মাগধির বদলে গৌড়ীয় প্রাকৃতবলে একটি স্তরের কল্পনা করেছিলেন, যদিও এই অভিমত খুব বেশি স্বীকৃতি পায় নি। শহীদুল্লাহের মূল খ্যাতি আঞ্চলিক ভাষা বৈচিত্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে যা তিনি করেছিলেন, তাঁর অভিধানে। একই বিভাগে অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করে খ্যাত তৃতীয়জন অবশ্যই সুকুমার সেন। ১৯৩৯এ প্রকাশিত তাঁর ভাষার ইতিবৃত্তঅনেকটাই আসলে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মহাগ্রন্থের বাংলা ভাষাতে অনুসৃতি। শহীদুল্লাহেরবাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্তইচ্ছে করলেই এই ব্যাপারে প্রথম বই হতে পারত। কিন্তু সেটি প্রকাশিত হয় বহু পরে, ঢাকাতে ১৯৬৫তে। ততদিনে আব্দুল হাইদের নেতৃত্বে ভাষাবিজ্ঞানের চেহারা পালটে যাচ্ছে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় অর্থ ও বাক্য তত্ত্ব স্পর্শ করেন নি। সুকুমার সেন করেছেন। এছাড়াও বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্যতাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষাবিষয়ক বই। বাদবাকি আগ্রহ তিনিও দেখিয়েছেন সেই বৈদিক গদ্যে, প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতে, মধ্য ভারতীয় আর্যে। তাঁর মহাগ্রন্থ আসলে বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস।বোঝা যায় ভাষার ইতিহাস লিখতে গিয়ে এঁরা প্রত্যেকেই সাহিত্য, জাতি, ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে কাশি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সত্য স্বরূপ মিশ্র ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগুলো নিয়ে বেশ গভীরে গিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৬৮তে প্রকাশিত তাঁর এ কোম্পারেটিভ গ্রামার অফ স্যান্সকৃত, গ্রীক, হিট্টাইটবই। হিত্তিয় ভাষা বিশ শতকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেদিক থেকে তাঁর বইটি মূল্যবান। তার উপরে একজন ভারতীয় ভাষাবিজ্ঞানী অভারতীয় ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন। সংস্কৃত ব্যাকরণকে টীকা ভাস্যে যে জটিল করে তুলে ছিলেন প্রথাগত বৈয়াকরণিকেরা , সেই জটিলতাকে নতুন ঢঙে সহজ করে তোলেন সত্য স্বরূপ মিশ্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে আরেকটি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ নাম পরেশচন্দ্র মজুমদার। ভারতীয় প্রায় সমস্ত আর্য ভাষাগুলো নিয়ে ধারণা পেতে যাঁর গবেষণাদি এখনো অবিকল্প। এরকম আরও কিছু নাম, নির্মল দাশ, মৃণাল নাথ প্রমুখ। চর্যাপদ নিয়ে অধ্যাপক মৃণাল নাথের সাম্প্রতিক গবেষণাতে তিনি দাবি করেন, চর্যার পদগুলো যদি বাংলা-অসমিয়া-ওড়িয়া ইত্যাদি একাধিক পূর্বভারতীয় ভাষার আদিরূপ হয়েই থাকে, তবে সেগুলোকে প্রাচীন বাংলা, প্রাচীন অসমিয়া ইত্যাদি বলবার কোনও মানে হয় না। আসলে চর্যার ভাষা এই সমস্ত ভাষার এক সাধারণ প্রত্নরূপ। এছাড়াও তিনি সর্বানন্দের টীকা সর্বস্বএবং শ্রী কৃষ্ণকীর্তনের সংস্কৃতমূল যাবতীয় শব্দের বাগর্থমূলক অধ্যয়ন করেছিলেন।
            সুনীতি কুমারের ১৯২৮শে লন্ডনে প্রকাশিতএ বেঙ্গলি ফোনেটিক রিডারএর প্রথম ভারতীয় সংস্করণ বেরোয় মাত্র সেদিন ১৯৮৬তে। ১৯২১শে প্রকাশিত তাঁর এ ব্রিফ স্কেচ অফ বেঙ্গলি ফোনেটিক্সএরই পূর্বসূরী। এমন কিছু বিচ্ছিন্ন প্রয়াস আরও ছিল। বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত না হয়েও অধ্যাপক বিজন বিহারি ভট্টাচার্য ১৯৫০এবাগর্থনামে একটি বই লেখেন যেখানে চলিত বাংলা ও তার বানান , মেদিনীপুরের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ প্রণালী ইত্যাদি আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাস প্রসঙ্গ টানেন নি। আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের কিছু পরিচয় প্রথম দেবার চেষ্টা করেছিলেন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক সুকুমার বিশ্বাস ১৯৬৮তে প্রকাশিত তাঁর ভাষাবিজ্ঞান পরিচয়গ্রন্থে। কিন্তু ভারতে মার্কিন দেশে গিয়ে ভাষা বিজ্ঞানী গ্লীসনের থেকে দীক্ষা নিয়ে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের যথার্থ সূচনা করেন সুহাস চট্টোপাধ্যায়।লেখ্য ও কথ্য বাংলার সম্পর্কনিয়ে তিনি গবেষণা করেন। ১৯৭২এ প্রকাশিত তাঁরত্রিপুরার কগবরক ভাষার লিখিতরূপে উত্তরণবইটি আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষাতে কোনও ভোটবর্মী ভাষা নিয়েও প্রথম বই। তাঁরই ছাত্র ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরী ত্রিপুরাতে থেকে কগবরকএবং সম্পর্কিত অন্যান্য ভাষাতে গবেষণা করে প্রায় প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছেন। বাংলা ভিন্ন পূর্বোত্তরীয় ভাষাগুলো নিয়ে এতো বিশাল মাপের গবেষণাদি বাংলা ভাষাতে প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁর ককবরক ভাষা ও সাহিত্যবইটিকে ত্রিপুরা সরকার শ্রেষ্ঠ বইয়ের পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানিয়েছে। প্রায় একই সময়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশির কুমার দাশও এই পথে বেশ কিছু কাজে হাত দেন। ১৯৭৩এ প্রকাশিত তাঁর স্ট্রাকচার অফ মাল্টোঃ এ দ্রাবিড়িয়ান ল্যাঙ্গুয়েজএবং এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা রয়েছে। এই সময়ে তিনি চতুষ্কোণপত্রিকার জন্যেও ভাষা-জিজ্ঞাসানামে বাংলাতে একগুচ্ছ প্রবন্ধ লিখে এই নতুন বিদ্যার সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করেন। ১৯৭৫এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু একই রকম কাজ করেন ১৯৭৫এ প্রকাশিত বাংলা ভাষার আধুনিক তত্ত্ব ও ইতিকথাগ্রন্থে। তিনি ছিলেন মূলত ঐতিহাসিক-তুলনামূলক ভাষা বিজ্ঞানের ছাত্র। ফলে দুই পথের এক সমন্বয়ের প্রয়াস তাঁর মধ্যেও দেখা যায়। তবে এই ধরণের ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতিতত্ত্ব সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনার দিকে থেকেও বাংলাদেশই অগ্রণী। ১৯৭০এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ভাষাতত্ত্বগ্রন্থে সামগ্রিক আলোচনা করেন। এই দশকে প্রণবেশ সিংহ রায় এরকম কিছু কাজ করেন। ১৯৭৬এ প্রকাশিত তাঁর লিঙ্গুইস্টিক স্কেচ অফ আ সান্তালি ইডিওলেক্টসম্ভবত কোনও জনজাতীয় ভাষা নিয়ে বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানীর দ্বিতীয় রচনা। কিন্তু ইংরেজিতে। এই সময়েই চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমূলক সৃজনীমূলক ভাষা বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটান পবিত্র সরকার তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থাবলীতে। পবিত্র সরকারের নেতৃত্বে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিবাংলা বানানে সমতা বিধানের কথা মাথাতে রেখে একটি নতুন অভিধান সংকলন করে এবং প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেশ কিছু লিপি সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে রেখেছে, আমরা সবাই জানি। রামশ্বর শদাবি করেন, ভাষা বিজ্ঞানের নীতি পদ্ধতি নিয়ে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ আলোচনা তিনিই করেন, ১৯৮৪-৮৮তে প্রকাশিত তাঁর সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষাতে।কেবল নীতি পদ্ধতি নয়, বইটিতে তিনি ভারত এবং পশ্চিমাবিশ্বে ভাষাবিদ্যা চর্চার শুরু থেকে আজ অব্দি ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শতাধিক পৃষ্ঠার বেশি ব্যয় করে মূল্যবান কাজ করেছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে। বাংলাদেশে একই বছরে এর সমতুল্য এবং অথচ স্বতন্ত্র চরিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন হুমায়ুন আজাদ তাঁর দুই খণ্ডে বিশাল বাংলা ভাষাসংকলনে। রামেশ্বর শতাঁর বইতে প্রথাগত এবং আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক দুই দৃষ্টিতেই বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব থেকে বাক্য তত্ত্ব অব্দি আলোচনা করেছেন। অন্যদিকে, হুমায়ুন আজাদ অন্যথা দুষ্প্রাপ্য সেই মনোয়েলের অভিধান থেকে শুরু করে একেবারেই একালের ভাষাবিজ্ঞানের গবেষকদের , প্রায় আড়াইশত বছরের বাছাই করা রচনাকে দুই মলাটে ধরে ফেলবার চেষ্টা করেছেন। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মহাগ্রন্থের পরে বাংলাভাষার যে কোনও ছাত্র-গবেষকদের কাছে এই দুই মহাগ্রন্থ অবশ্য পাঠ্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত বলে আমাদের মনে হয়। হুমায়ুন আজাদের একই বছরে প্রকাশিতবাক্যতত্ত্বসম্পর্কে রামেশ্বর শসপ্রশংস মন্তব্য করে লিখেছেন, “...বাক্যতত্ত্বে এমন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা শুধু বাংলা ভাষায় কেন; অন্য কোনও ভাষা হয়েছে কিনা সন্দেহ।ষাটের দশকের পরে ভাষা বিজ্ঞানে বৈচিত্র্য প্রচুর বেড়েছে শৈলী বিজ্ঞান, সমাজ ভাষাবিজ্ঞান, ছন্দ বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা শাখাতে কাজ হয়েছে। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বীরেন্দ্র রক্ষিত যেমন ১৯৭৩এ অসমীয়া ছন্দের উৎসনিয়ে কাজ করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের বাংলা অভিধান গ্রন্থের পরিচয়গবেষকদের সহায়ক একটি মূল্যবান গ্রন্থ। রামেশ্বর শতাঁর গ্রন্থের শেষের দিকে ভারতে এখনো ভাষাবিজ্ঞান গবেষণাতে খামতি আছে আছে এমন কিছু দিকের একটি তালিকা দিয়েছেন। সেগুলো গুরুত্ব পূর্ণ নিশ্চয়। কিন্তু উপভাষা নিয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, বাংলার প্রতিবেশি ভাষা , বিশেষ করে খাসিয়া’, ‘বডোইত্যাদির মতো অনেকগুলোই আসলে নৃগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির নানা অংশের এককালে মাতৃভাষাই ছিল সেগুলো নিয়ে বাংলা ভাষাতে অধ্যয়ন এখনো অতি অল্পই হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, হাজং, রাজবংশি এমন বেশ কিছু ভাষা আছেসেগুলো পাশাপাশি অধ্যয়ন না করলে প্রাচীন মোঙ্গল, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ভাষাগুলোর থেকে আধুনিক আর্য ভাষা হিসেবে বাংলার উঠে আসার মধ্যবর্তী পর্যায়কেও ভালো করে বোঝা প্রায় অসম্ভব।
             ইতিহাসও ঐতিহাসিক ভাষা বিজ্ঞান যেখানে একটা বড় প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাতে ভাষাবিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করত, আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষা বিজ্ঞান ছোট এলাকার দিকে তাকানোকেও মর্যাদা সম্পন্ন করে তোলে। বোধ করি তাই, বাংলা ভাষাতে উপভাষা বিজ্ঞানেও এই সময়েই আগ্রহ বাড়ে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহের উপভাষা বিভাজনকে অস্বীকার করেই শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ১৯৬১তেই ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন সিলেটি ভাষা তত্ত্বের ভূমিকা অবশ্য, আমরা আগেই লিখেছি, আমরা যেগুলোকে বাংলার উপভাষা বলি, সুকুমার সেন সেগুলোকেউপভাষাগুচ্ছলিখেছিলেন। শহীদুল্লাহ বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাংলার অভিধান সংকলন করতে গিয়ে প্রায় প্রতি জেলার এক বা একাধিক ভাষাবৈচিত্র্যকেউপভাষানাম দিয়ে আলাদা চিহ্নিত করেছেন। ষাটের দশকের আগে অব্দি উপভাষা গুলোর শব্দ সংকলন ছাড়া কাজ বিশেষ হয় নি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সেই শব্দ সংগ্রহের উৎসাহ এতো ব্যাপক বেড়েছিল যে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় গ্রাম্য শব্দ সংকলনবলে এক প্রবন্ধে উপভাষা চর্চার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে শব্দ-সংকলনের নীতি বেঁধে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, আর বলেছিলেন গ্রিয়ার্সনের বিহার পেজেন্ট লাইফবইটি সংগ্রাহক এবং সংকলকদের আদর্শ হতে পারে। যাই হোক, ষাটের দশকের পরেই দেখা যাচ্ছে শব্দ সংকলনের অতিরিক্ত উপভাষার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাষাবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তথা তুলনামূলক আলোচনাতে গবেষকেরা আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছেন। যথারীতি ঢাকার উপভাষা নিয়ে আব্দুল হাই-র একাধিক রচনা ছাড়াও মুনির চৌধুরী,মনিরুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ অনেকেই এই কাজে হাত দেন। উপভাষা নিয়ে চর্চার এক দীর্ঘতালিকার উল্লেখ করেছেন রামেশ্বর শতাঁর সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষাবইতে। রামেশ্বর শতিন দশক আগে অব্দি উপভাষা গবেষকদের দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন, তাঁর মধ্যে কামরূপি উপভাষা নিয়ে অরুণ কান্তি মুখোপাধ্যায়, প্রান্ত-উত্তর বঙ্গের উপভাষা নিয়ে নির্মলেন্দু ভৌমিক, নির্মল দাশ, ঝাড়খণ্ডি উপভাষা নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ সাহা কাজ করেছেন। সম্প্রতি অসমে জগন্নাথ চক্রবর্তী এবং আবিদ রাজা মজুমদারের অভিধান দুখানা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনহাফলং থেকে ১৪১২ বাংলাতে প্রকাশিত জগন্নাথের বইয়ের নাম বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্বএতে তিনি একটি ব্যাকরণও জুড়েছেন। শিলচর থেকে ২০১১তে প্রকাশিত আবিদ রাজা মজুমদারের বই বরাক উপত্যকার কথ্য বাংলার অভিধান এই দুই গ্রন্থের মাপে অসমে এর আগে কোনও কাজ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু দুজনের কেউই বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা বা কথ্য বাংলাকে সিলেটিবাকাছাড়িকোনও নামেই চিহ্নিত না করে ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্যে প্রশ্ন চিহ্ন তুলে রেখেছেন বলে আমাদের অভিমত। যার মোকাবেলা না করে ভবিষ্যত গবেষণা সম্পন্ন হতে পারে না। আগরতলার রামঠাকুর কলেজের অধ্যাপক রবীন্দ্র দত্তেরনোয়াখালি ও চট্টগ্রামের উপভাষাঃ একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণকাজটি ১৯৯৮তে করা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ। ২০১১তে বই হিসেবে বেরিয়েছে। ২০০৪এর ১৯শে মে ভাষা শহীদ দিবসে রতন বিশ্বাসের সম্পাদনাতে প্রকাশিত হয়েছেউত্তর বঙ্গের ভাষানামে একটি প্রবন্ধ সংকলন। সেখানকার প্রতিবেশি ভাষা গুলোর সঙ্গে বাংলার বিচিত্র ভাষা বৈচিত্র্য নিয়ে এই বইটি একটি মূল্যবান সংযোজনা বলে আমাদের মনে হয়েছে। তেমনি ১৪১৮ বাংলাতে কলকাতার থেকে প্রকাশিত কোরকসাহিত্য পত্রিকার প্রাক-শারদ সংখ্যা আমাদের সংগ্রহে এসেছে, যে সংখ্যাটির বিষয় হিসেবেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন, ‘পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা গ্রিয়ার্সনের ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার প্রায় শতবর্ষ পরে ২০১০ সনে বরোদার ভাষা গবেষণা এবং প্রকাশন কেন্দ্রের নেতৃত্বে আরেকটি সারা ভারত ভাষা সমীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে, “ ভারতীয় জন ভাষা জরিপ’ (Peoples LinguisticSurveyof India: PLSI) এর মুখ্য সম্পাদনার দায়িত্বে রয়েছেন, অধ্যাপক গণেশ নারায়ণ ডেভী। ইতিমধ্যে এদের কিছু কিছু প্রাথমিক প্রকাশনা বাজারে এসেছে। এরা প্রতিটি প্রদেশের জন্যে আলাদা দলকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে একই ভাষা যদি একাধিক প্রদেশে রয়েছে, সেই ভাষাগুলোর একাধিক গবেষক দিয়ে একাধিক অনুসন্ধানও হচ্ছে। তথা প্রাদেশিক বৈচিত্র্যও বেরিয়ে আসছে। এমনকি প্রতিটি খণ্ড ইংরেজিতে এবং প্রাদেশিক প্রধান ভাষাতেও অনুদিত হচ্ছে। যেমন অসমের প্রকাশনাটি পঞ্চম খণ্ড। এবং এর অসমিয়া অনুবাদ রয়েছে। তাতে অসমের বাংলা ভাষাও সন্নিবেশিত হয়েছে। এর সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে রয়েছেন বিভা ভরালী এবং বনানী চক্রবর্তী। তেমনি পশ্চিম বাংলারটি হবে ত্রয়োদশ খণ্ড; ত্রিপুরার অষ্টাবিংশ খণ্ড। এদের আন্তর্জালিক সাইট রয়েছে: http://peopleslinguisticsurvey.org এই কাজটি সম্পূর্ণ হলে ভারতীয় ভাষাগুলো সম্পর্কে বহু নতুন কথা সামনে আসবে বলে আমাদের মনে হয়। যদিও পঞ্চম খণ্ডটিতে  এবং এদের সাইটে নজর বুলিয়ে এই সন্দেহ আমাদের তীব্র হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান আয়োগের নির্দেশিত অধ্যাপকদের এ পি আইজমানাতে নিষ্ঠা এবং সততাপূর্ণ কাজ বিরল হতে চলেছে। বৃহত্তর কোনো সামাজিক দায়ের উপরে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে তাদের ব্যক্তিগত পদোন্নতির দায়। সেইসব পদোন্নতি দায়গ্রস্তরাই গিয়ে সানন্দে ভিড়ছেন জন ভাষা জরিপের দলেসম্ভবত তাই এতো দূর এগিয়েও এই জরিপ ভাষা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষ কোনো আগ্রহ জন্মাতে পারে নি। তবে শেষটা কী দাঁড়ায় এখনো দেখবার বাকি।



Comments

Popular posts from this blog

।।রোমান হরফে বাংলা লেখার পুরাকথা । ।

।। অসমিয়া-বাংলা- সিলেটি লিপি ।। সপ্তম অধ্যায় ৷৷

।। অসমিয়া,মানবাংলা,সিলেটি এবং দু’একটি প্রতিবেশী ভাষা ও ভাষাবৈচিত্র্যের ধ্বনিতাত্ত্বিক তুলনা ।। তৃতীয় অধ্যায় ৷৷